কে তোমাকে উৎসাহিত করেছিল ?
সীমাহীন বাঁধার পাহাড় ভেঙ্গে, দুহাতে কালো মেঘ পেছনে ঠেলে, উঁচু-নীচু, আঁকা-বাঁকা পথ পেরিয়ে, আজ তুমি এসে দাঁড়িয়েছ স্বপ্নের মসনদে। জীবন; প্রশ্ন করো নিজেকে, কতটুকু দিয়ে গেলে পৃথিবীতে এসে? যতটুকু পেয়েছিলে, যতটুকু অর্জন করেছিলে, যত টুকু সঞ্চয় তোমার আপন মসনদে বসে থাকার?
প্রশ্নটা খুব সহজ, কিন্তু উত্তরটা জানা আছেকি?
অচিনপুর রেল ষ্টেশনের বেলা শেষের ট্রেন ধরবে বলে হাঁটতে-হাঁটতে ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত এক মধ্যবয়স্ক লোক নদীর ধারে বুড়ো বটগাছটার নীচে এসে বসলে পর ভাবনাগুলো তার মাথার ভিতর রঙিন পাখনা মেলে। সুর্য ডুবে গেছে ক্ষনেক আগেই, আকাশে এখনও লেপ্টে আছে বিদায়ের রক্তিম আভা। পাখিরাও ফিরে গেছে আপন নীড়ে।
ইদানীং প্রায়ই এমন হয়, একটুতেই ক্লান্তি এসে ভর করে শরীরে, মনের মধ্যে মাতাল ঝড়ো হাওয়া। লাগাম ছাড়া ভাবনাগুলো এলো-মেলো করে দেয় সবকিছু। তখন আর কিছু ভালো লাগেনা, কিছুতেই গতি আসেনা, শুধু শুধু অতীতের ছেঁড়া পান্ডুলিপির ঝাপসা হয়ে যাওয়া পৃষ্ঠা পানে চেয়ে থাকা।সেখানে কালো হরফে লেখা অক্ষরগুলো বড় অচেনা লাগে।
যেখানে লেখা ছিল সাথের সাথীদের নাম, পথের পাথেয়, পারা-পারের মাঝি, সিঁড়ির উপরে হাত বাড়িয়ে প্রতিক্ষমান কেউ;যেখানে লেখা ছিল অগণিত নির্ঘূম রাত, অন্তরের অন্ত:স্থলে জমে থাকা না বলতে পারা কথা, ভাঙ্গা-চোরা, ভেঙ্গে-ভেঙ্গে ক্ষয়ে যাওয়া অতীতের অক্ষমতা।
বুকের খুব গভীরে যুদ্ধ চলে অবিরত, অবিরত হয় রক্তক্ষরন, দেখা যায়না, শুধু মনে পড়ে যায়, শুধু মনে পড়ে যায়, হারানো ছেলে বেলা, হারানো কৈশোর, দুরন্ত বিকেল, নি:সঙ্গ সন্ধ্যায় একাকীনি:স্বঘরে ফেরা, সারাদিন পথে পথে একা একা ঘুরে ঘুরে অবসন্ন মন, বুকের ভিতরে নীল ভ্রমরার ইচ্ছেগুলো নীরবে বিসর্জন, স্বপ্নীল সবুজ আঁধার। ডুব সাঁতারে অতল গহ্বর পাড়ি দিয়ে, ভালবাসা-প্রেম,অবিশ্বাস সব পেছনে ফেলে সম্মুখে এগিয়ে চলা, শুধু এগিয়ে চলা। স্বাক্ষী আছে প্রতিটি চুয়ে পড়া ঘামের লবনাক্ত জলের ফোঁটা, নিরব স্বাক্ষী হয়ে আছে হেঁটে যাওয়া প্রতিটি ধূলো উড়া পথ, রেখে আসা পদচিহ্ন। ভারী হওয়া নিঃশ্বাসে হতাশার দীর্ঘশ্বাস, কেমন আছ তুমি প্রাচীন নগরীর এক টুকরো লাজুক ঝুমকলতা?শেষ কথা বলা হয়নি তোমাকে আজও।
আজও সেই পথ ছুটে চলা। অসীম আগামীর পথে ছুটে চলা, মনে পড়ে যায় ফিরতি পথে অপেক্ষাতে থাকেনি কেউ, কেউ বলেনি মলিন মুখ পানে চেয়ে “কেমন আছিস খোকা”।
বহু দূরে ট্রেনের হুইসেল বাজছে, কিছু বাদে প্লাটফর্মে এসে দাঁড়াবে। কিছু লোক নেমে যাবে, চলে যাবে কিছু লোক, ফিরে যেতে হবে আমাকেও, এই যাওয়া আসার মাঝেই কেউ দিয়ে যায় কিছু, কেউ ফিরে যায় নিঃস্ব হয়ে। ঢং ঢং ঢং করে ষ্টেশনে ঘন্টা বাজছে, মনের ঘরে বাজছে স্কুলের ছুটির ঘন্টা, পরম স্নেহে মাখায় হাত রেখে বলেছিল বৃদ্ধ মাষ্টার, “সত্যের পথে এগিয়ে চল, সত্য তোকে মুক্তকরবে, তোকে নিয়ে যাবে বিজয়ের পথে” বৃদ্ধ মাষ্টার চলে গেছে না ফেরার দেশে। সেই ভাঙ্গা-চোরা স্কুলটা আজ বড় হয়েছে অনেক, পাকা দালান, বারান্দাতে ছেলে-মেয়েরা পড়তে আসে দূর-দুরান্ত থেকে, চোখে তাদের অনেক স্বপ্ন, অন্তর গভীরে এগিয়ে যাবার প্রত্যাশা, সেই স্কুলে এখন আমি হেডমাষ্টার, মাঝে পেরিয়ে গেছে অনেকগুলো বছর, জীবন আমাকে পরিপূর্ণতায় ভরিয়ে দিয়েছে, প্রত্যাশা জাগিয়েছে বেঁচে থাকার, জীবনের শেষ দিন পর্যন্তবলে যেতে হবে, শিক্ষা দিতে হবে ওদেরকে, সত্যে বাঁচো, সত্যে থাকো।
দূর থেকে ট্রেনের আলো এসে চোখে লাগে, উঠতে হবে, ষ্টেশনে ট্রেনে চেপে ঘরে ফিরতে হয় প্রতিদিন।
আমরাও ফিরে যাই প্রতিদিন, পায়ে-পায়ে ভেঙ্গে যায় সাফল্যের পথ, কিন্তু একবারও কি ভেবে দেথেছি আজ যে সাফল্যের মসনদে বসে আছি, সেখানে বসার জন্য কেউনা কেউ একজন সেই বৃদ্ধ মাষ্টারের মতো গায়ে হাত রেখে শিখিয়ে ছিল সাফল্যের মূলমন্ত্র, অন্তরের গভীরে বুনেদিয়েছিল সেই বীজ। কেউ একজন দেখিয়ে ছিল জীবনের পথ, উপরে উঠার সিঁড়ি ভাঙ্গতে কেউ একজন শিখিয়ে দিয়েছিল পরম মমতায়, কে সেই জন, মনে পরে কি তাকে ? প্রশ্নটা খুব সহজ, উত্তর ?
- Why is so much moral degradation? - August 26, 2019
- কেন এত নৈতিকতার অবক্ষয়? - August 26, 2019
- Why do we prioritize our self-interest first? - July 11, 2018