শেষের ঠিকানা কোথায় ?

একদিন পথে যেতে যেতে দেখা হয়েছিল তার সাথে। তার সাথে মানে তার-ই সাথে। একদিন তার সাথে হয়েছিল কথা। কথা মানে অন্ত:স্থলের ভাষা বোঝাবার নিরন্তর প্রচেষ্টা। তার সাথে মানে তার-ই সাথে। তবুও ঘোর কাটেনা আমার, অন্ত:ঘোর। তবু ভ্রান্তি গেলনা আমার, পোড়া মনের ভ্রান্তি। অথচ তার সাথেই আমার নিরন্তর বসবাস। তার সাথেই ছুটে চলা নিরন্তর। পথ চলতে-চলতে দেশ থেকে দেশান্তর। পথ চলতে-চলতে আদি থেকে অনন্তকাল শুধু বিরামহীন ছুটে চলা। বিরামহীন বৈঠা বেয়ে যাওয়া অসীমতায়। ছুটে চলার তবু শেষ নেই, প্রশ্নের তবু শেষ নেই। জানা-অজানার তবু শেষ নেই। বলা-না বলা কথার কোন শেষ নেই। পথের নেই শেষ, যত পথ তত মত, যত মত তত পথ। আর সমস্ত মত-পার্থক্যের মাঝে অবিরাম এগিয়ে চলা। কখনও ছায়ার সাথে কথা বলা একাকি আনমনে, আসলে কি ছায়া নাকি বিবেকের সাথে? কিছু উওর মিলে যায় খুব সহজে, কিছু থেকে যায় ধোঁয়াশা, বাড়িয়ে তোলে প্রতীক্ষার যাত্রা, অস্বস্তিকর জটিলতা, ঠিক যেমন এই মুহর্তে- ক্লাশের সব থেকে নিরীহ শান্ত ছেলেটির কাছ থেকে পাওয়া প্রশ্নটিই শিক্ষকের মনে অবিরাম প্রতিধ্বনি তুলছে, অস্থির চিন্তাগুলো এলো-মেলো করে দিচ্ছে সব কিছু, অস্বস্তিকর ধোঁয়াটে ভাবনাগুলো যন্ত্রনার ঝড় তুলছে অন্তর গহিনে, অস্বস্তি বেশিক্ষন সহ্য করা যায় না, শিক্ষক তাই ক্লাশের নিরীহ শান্ত ছেলেটির কাছ থেকে পাওয়া প্রশ্নটিই উন্মুক্ত করে দিলেন সবার জন্য, প্রশ্নটি ছুঁড়ে দিলেন ক্লাশ রুমের প্রতিটি ছাত্রের উদ্দ্যেশে-

”আচ্ছা বল তো তোমাদের মধ্যে কে দিতে পারবে এই প্রশ্নের উত্তর?” উপস্থিত ছাত্র সবাই এ-ওর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে, কে উত্তর দেবে বুঝে পায় না। যদি ভুল হয়ে যায়, যদি এই ভুলের কারণে পাপ হয়?

অনেকক্ষন নিরবতা, অনেক নিরবতার পরে পেছন থেকে উঠে দাঁড়ায় শ্রী গদা ঠাকুরের ছেলে “বিষু ঠাকুর”।

কিরে বিষু এই প্রশ্নের উত্তর কি তোর জানা আছে ?

বিষু বলে ”পাপের উৎপত্তি কবে-কোথা থেকে তা ঠিক বুলতি পারব না স্যার, কিন্তু কি করলি পাপ হয় তা বলা যাতি পারে, আর এইটুক দিব্বি করি বলা যায় যে ভগবান পাপের উৎপত্তির ব্যাপারে ওয়াকিবহাল ছিলনা।”

শিক্ষকের কৌতুহলি চোখ ঘুরে ফেরে সবার মুখ পানে, এইতো এদের মধ্যেই কারো না কারো কাছে আছে এর উত্তর। আশার ক্ষন ঘনিভূত হকে থাকে, পাশ থেকে আর একজন ছাত্র উঠে দাঁড়ায় নাম “মোহাম্মদ আলি”

”কিরে আলি তুই কিছু বলতে চাস?”

”স্যার আমি যেডা বুলতি চাই সেডা হচ্ছে আল্লা-খোদার বিষয়ে বেশি ঘাটা-ঘাটি করাডাই হচ্ছে পাপ। আর যেই বিষয়ডা হচ্ছে আল্লাহ মানুষকে মাটি দিয়ে তৈরী করার পর তার ফেরেস্তাদের বল্লেন “মাটির তৈরী আদমকে সেজদা করতি” তখন একজন ফেরেস্তা সেই আদেশ অমান্য করল, আর সেই আদেশ অমান্য করার কারনেই প্রথম পাপের উৎপত্তি হইছিল। আর সেই কারনে আল্লাহ সেই ফেরেস্তাকে শাস্তি হিসাবে ফেরেস্তা থেকে শয়তান করে দিল।”

আর একজন ছাত্র উঠে দাঁড়াতেই শিক্ষকের মনে আবার নতুন আশা উঁকি মারে, এইত আরও নতুন উত্তর আরও নতুন ভাবনা।

”কিরে মাইকেল তুই কি কিছু বলতে চাস?”

”স্যার আমি যত দূর জানি তা হচ্ছে আমাগের পবিত্র বাইবেল মতে, ঈশ্বর মানুষকে তাঁর মতো করে মাটি দিয়ে তৈরী করল্লো আর সেই মতে জগতের সব কিছুর উপর কতৃর্ত্বও করতি দিল, কিন্তু ঈশ্বর যে ফল তাদের খাতি নিষেধ করিছিল আদম-হাওয়া সেই ফল খালো শইতানের কুমন্ত্রনাতে, যার কারনে আদম-হাওয়া ঈশ্বরের অবাধ্য হল, আর সেই অবাধ্যতাই হচ্ছে মানব জাতির প্রথম পাপ। কিন্তু ঈশ্বরতো পাপ কে উৎসাহিত করে নায়। আর তিনি মানুষকে জ্ঞান বুদ্ধি দিল যেন মানুষ সব কিছুর উপর বিবেচনা করিই চলতি পারে, কতৃর্ত্ব করতি পারে, বিজয়ী হতি পারে, সুতরাং এখেনে পরিস্কার ভাবে বুলা যাতি পারে যে “মানুষ পাপে পতিত হবে সে বিষয়ে ঈশ্বরের জানা ছিল-কিনা সেই উত্তর না খুঁজিই আমাগের উচিত হবে পাপের বিষয়ে সচেতন হওয়া আর অনুতপ্ত হওয়া”। আর আমার কাছে মনে হয় এইডাই সব থেকে বড় সত্য যদি আমরা আমাদের পাপের কারণে অনুতপ্ত হই তাহলি তিনি আমাদের ক্ষমা করিই দেবে।

আবার একটু নীরবতা, কিছুটা সময় চলে যায় এভাবেই। কাকনপুর গ্রামের মরা নদীটার ধারে ভাঙ্গা-চোরা স্কুলের জানালা দিয়ে শ্রেণী শিক্ষকের চোখ চলে যায় বহু দুরে, ক্লাস রুমে অস্থির নিরবতা, অস্থিরতা শিক্ষকের বুকের মধ্যে। এই যে নিরবতা, এই যে শব্দহীন বুকের গভীরে নিরব বিপ্লব, বিবেকের সাথে কথা বলা, এভাবেই, তবু এভাবেই তোমার সাথে দেখা প্রতি নিয়ত, এভাবেই তোমাকে খুঁজে ফেরা জন্ম থেকে জন্মান্তরে, কথা হয় তোমার সাথে এভাবেই, সে কথা শুনতে পায় না কেউ, বোঝে না সেই ভাষা, তাই মনের আঁধার ঘোচে না, আমার কাটেনা অন্ত:ঘোর। জানা-বোঝার শেষ হয় না এক জীবনে আমার, পথ যে ফুরিয়ে যায় আমার, বেলা হয়ে যায় শেষ তবু প্রশ্নের উত্তর মেলে না, ভ্রান্তির হয় না শেষ।

তবু কোন এক অবেলায় বুকের গহিন কোনে কেউ এসে বলে যায় “আমি আদি থেকে অনন্তকাল তোমার সঙ্গে-সঙ্গে আছি, পাপ থেকে মন ফিরাও, অনুতপ্ত হও, আমি কখনই তোমাকে ছেড়ে যাব না। যে বোঝা তোমরা বহন করতে পারবেনা তা তোমাদের উপর কখনই চাপিয়ে দেব না বরং যুগের শেষ পর্যন্ত আমি তোমাদের সঙ্গে-সঙ্গে আছি, থাকব।

দপ্তরি ছুটির ঘন্টা দিচ্ছে, অনেক আনন্দ-উৎফুল্লতা নিয়ে ক্লাশ ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে  সকলে, বাড়ি ফিরছে ছেলে-মেয়েরা, কিন্তু জীবনের শেষ ঘন্টা যখন বেজে ওঠে তখনও কি আমরা এমনি আনন্দ-উৎফুল্লতা নিয়ে ফিরে যেতে পারি আমাদের শেষ ঠিকানাতে? কেননা সেখানেইতো শুরু হবে আমাদের নতুন করে আবার বেঁচে উঠা, সেখানেই তৈরী হবে আমাদের আর এক নতুন আশ্রয়, এমনি ভাবনাতে শিক্ষক যখন ডুবে আছে-ঠিক তখনি দূরে মরা নদীটার পাড় ঘেঁষে সবুজের আল ভেঙ্গে একতারা হাতে দরদী কন্ঠে একাকি আনমনে গেয়ে চলেছে অচেনা কোন বাউল, “এক দেশে যা পাপ গোণ্য, অন্য দেশে পূণ্য তায়, পাপ পূণ্যের কথা আমি কারে বা শুধাই” ধীরে ধীরে নদীর স্রোতের সাথে মিলি যেতে থাকে সেই সুর, মিলে মিশে একাকার হয়ে যায় সমস্ত অস্থির ভাবনা গুলো। মিলে-মিশে একাকার হয়ে যায় আর বিবেকের ক্যানভাসে লেখা হতে থাকে অন্য এক কাব্য ”যে ভালো কাজ করতে জানে অথচ না করে, সে পাপ করে”।

Follow me

You may also like...